
‘৩৬ জুলাই নাকি ৩৬ জুলাই’ – বেলা ১১টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে পৌঁছানোর পর সবার আগে কানে ভেসে এলো সাউন্ডবক্সে ছেড়ে দেওয়া একটি গানের এই লাইন। সড়কে ঢোকার মুখেই ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাধারণ মানুষের চলাচল আটকে রাখা হয়েছে সেখানে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ব্যারিকেড পার হয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা গেল একটা পিকআপ ভ্যানের ওপরে বড় স্ক্রিন আর সাউন্ডবক্স লাগিয়ে একের পর এক চলছে দেশাত্মবোধক গান। ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে রাস্তাটির অপর প্রান্তেও, অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির পরের অংশেও। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায়, সেখানে আছেন কেবল টহলরত পুলিশ সদস্য আর সাংবাদিকরা।
এমনটাই দেখা গেছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ৫০ বছর পুরো হওয়ার দিনটিতে তার বাড়ির আশপাশের চিত্র। দুই বছর আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে এটা পুরোপুরি আলাদা এক দৃশ্য। ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট অতর্কিত হামলা চালিয়ে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।
এর প্রায় ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করে।
পরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করলে জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তা পুনর্বহাল করা হয়।
২০২৪ সালের অগাস্টে অন্তর্বর্তী সরকার আবার সেই স্বীকৃতি বতিল করে। তারপর থেকে পরপর দুই বছরই শোক দিবস পালনে বাধা দেওয়া হয়।
কিছুদিন আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছিলেন, ‘১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এটি দুঃখজনক। তবে এ দিনটি আগস্টের অন্য ৩১ দিনের মতোই। কেউ ধানমন্ডিতে বা কোথাও কর্মসূচি করতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এবারও ৩২ নম্বর সড়কের সামনে ঘটেছে বেশ কিছু হেনস্তার ঘটনা।
আজ সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপরই সড়কের মুখে জটলা বাঁধছে। সেই দৃশ্য ধারণ করতে হুড়মুড় করে এগিয়ে আসছেন মোবাইল আর ক্যামেরা হাতে থাকা মানুষজন।
খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আলাপ হয় পাশে থাকা আরেকজন সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, শুধু শোক জানাতে আসা বা দেখতে আসা বেশ কয়েকজনকে হয়রানি করা হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমেও ভাসছে এমন বেশ কিছু ভিডিও।
এর মধ্যে একটিতে দেখা গেছে, একজন মধ্যবয়সী নারী গণমাধ্যমকে বলছেন, ‘আজ ১৫ই আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিবস। আমি এখানে ফুল দিতে আইছি। আমার ফুলডি ফালায় দিছে।আমি কি মিছিল-মিটিং করতে আইছি?’
এসময় সানগ্লাস পরা একজন ব্যক্তি তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকলে পুলিশ ওই নারীকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এমনই আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ গণমাধ্যমে বলছেন, “দাঁড়িয়ে থাকাটাও আমার জন্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।’
এছাড়াও বছরের শুরুতে এই ৩২ নম্বরেই শেখ মুজিবের বাড়িটি ভাঙার সময় কাউকে থামানো হয়নি, কিন্তু আজ আইনশৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে বাড়িটি দেখতে দেওয়া হচ্ছে না কেন–– সেই প্রশ্ন করেন তিনি।
তখন সানগ্লাস পরা আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘হাসিনা যখন এতগুলো মানুষের প্রাণ নিলো, তখন আপনাদের হৃদয় একটু কাঁপে নাই!’
এসময় তার পেছন থেকে কেউ একজন ওই ব্যক্তিকে “আওয়ামী লীগ” ট্যাগ দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ধর, ওরে ধর’।
তবে বৃহস্পতিবার থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে বলা হচ্ছে–– আওয়ামী লীগকর্মী সন্দেহে এক শিবিরকর্মীকে মারধর করা হয়েছে শেখ মুজিবের বাড়ির কাছে।
ভিডিওতে মারধরের শিকার হওয়া মামুন নামের ওই লোক নিজের পরিচয় দেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা কলেজ শাখার প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে।
তাকে ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, কলাবাগানে তার বাসা হওয়ায় ৩২ নম্বর দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি, বরং আওয়ামী লীগের কর্মী সন্দেহে মারধর করা হয়।
এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে থাকলেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। সূত্র: বিবিসি