মশিকুর রহমান।
খুবই পরিচিত এক ধনী ব্যবসায়ী আমাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলেন আমি যেন তার বাসায় এক কাপ চা খাই , বিশেষ জরুরী একটা বিষয়ে তিনি কথা বলবেন। তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমার কাছের মানুষ , তাই তার অনুরোধ গ্রহন । সঙ্গে আমার সহকর্মী , সিবিএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি আজহারুল ইমাম ।
প্রকান্ড বাড়ি ! বাগানের এক পাশে ঢুকতেই চোখে পড়লো তার বাপদাদাদের ব্যবহৃত শেভ্রোলেট, ফিয়াট এবং অস্টিনের জং ধরা ভাঙাচোরা কয়েকটি পুরান গাড়ি । ঢাকা শহরে কয়েক বিঘার উপর এমন বিশাল বাড়ি ও পুরান গাড়ি জানিয়ে দেয় বনেদির খবর!
কুশলবিনিময়ের পর তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো “ ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বাংলাদেশ বিমান আর করবে না , আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দেয়া হবে , চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ফাইল এখন প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিমানের ইউনিয়ন খুব শক্ত। ওদের সাথে আগে কথা বলো । ওরা কিন্তু কয়েকদিন আগে ধর্মঘট করে এয়ারপোর্ট অচল করে দিয়েছে ! আমি এসব ঝামেলা আর দেখতে চাই না । ওরা না চাইলে এটা হবে না । তারই অংশ হিসেবে আমার প্রতি সরকার ও ঐ বিদেশি কোম্পানির পক্ষ থেকে দায়িত্ব পড়েছে আপনারা সাথে মিটিং করার ।”
আমার সাথে এ বিষয়টি আলোচনা করবে তো বিমান মন্ত্রী বা সরকারের কোন মনোনীত রাজনৈতিক নেতা । আপনিতো সরকারের ডেজিগনেটেড কেউ না !
তিনি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও ভালই একটা প্রতিউত্তর দিলেন । যাতে বুঝাতে চাইলেন মন্ত্রী এমপির কোন ভাত নেই । যাই হোক ধনী হলেও লজ্জা-শরমের ক্ষেত্রে তিনি খুবই দরিদ্র । তিনি সরাসরি বলে ফেললেন “ আপনাকে ৩ কোটি টাকা দেওয়া হবে। এবং আপনার কমিটির প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা করে দেওয়া হবে । ১১ জনের জন্য মোট ১৩ কোটি ! কোন আন্দোলন করা যাবে না ! “
আমি বড় মানুষদের সামনে ভুল করে উপস্থিত হয়ে পড়লে আমার চিন্তা চেতনা এবং কথা বলা বা উত্তরের ঢং ঢং তাদের মতোই হয়ে যায় । ( আল্লাহ এই একটা জায়গায় আমাকে খুব সাহায্য করেন) । দলের উপর মহলে আমার এ দুর্নামটা আছে।
– টাকা আপনাদের ব্যবসায়ীদের জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও অক্সিজেনসম অপরিহার্য । আমারমতো মানুষের জন্য টাকা প্রয়োজনীয় বটে, অপরিহার্য নয় । রাজনীতি এবং টাকা একসাথে চলে না ।
আমার এ কথায় তিনি কিঞ্চিৎ চটে গেলেন । ধনী মানুষ এবং ফৌজিরা সাধারণত সিভিলিয়ানদের সাথে তাদের অহংকার এবং রাগ বেশীক্ষন ধরে রাখতে পারেন না । তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না ।
– রাখেন এসব নীতি কথা , কত বড় বড় নেতা , আমলা দেখলাম !
– তিনি যত গরম হন আমি ততো নরম হয়ে বললাম ক্ষুদ্র হয়েও কখনো কখনো বড়র চেয়েও বড় হওয়া যায়, তাই না ?
এমন সময় ভদ্রলোকের স্ত্রী বাসার বাইরে বেড় হবার প্রাক্কালে হন্তদন্ত হয়ে ড্রংই রুমে উকি দিয়ে কিছু বলতেই আমাকে দেখলো । আরে ! মশিকুর ভাই , আপনি ! আপনি আমার বাসায় ! ও মাই গড ! ••••• আমিও অবাক হলাম যে, এই লোকের বউ এই ভদ্র মহিলা ! এ যে বৃন্দা বনে সীতা !
তার হাজবেন্ডকে শুধু বলল – তোমার বাড়িতে কাকে এনেছ তা তুমি জানো না ! ভদ্র মহিলা ভিতরে ফিরে গেলেন আরো বেশ কিছু খাবার দাবার টেবিলে সংযুক্ত করে , ব্যস্ততার অযুহাতে এক গাল হাসি ঢেলে দ্রুত প্রস্থান করলেন। আমি তার স্ত্রীর পূর্ব পরিচিতজন মনে করে ভদ্রলোকের কিছুটা সাহস বেড়ে গেল ! তবে আমার সাহসের সূচকে বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও পতন ঘটলো না !
আমাদের আলোচনায় একটু ভিন্নতা এলো ! ঘন্টা খানেকের বিভিন্ন গল্পগুজব শেষে উপসংহার টানা আবশ্যক মনে করে ছলে তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম ।
– আচ্ছা ভাই, বলনে তো সংসদ ভবন কে তৈরী করেছে?
– ভদ্রলোক হেসে বললেন কেন , স্থপতি লুইকান ! লুইকান সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু জানেন যা আমিও জানি না ।
– আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল সংসদ ভবন তৈরির জন্য টাকা কে দিয়েছিল ? আমতা আমতা করে বললনেন পাকিস্তান সরকার ।
– সরকার যদি লুইকান কে যদি বেশী টাকা দিতো এবং স্থাপত্য নকশায় একটু পরিবর্তন করতে বলতো লুইকান কি করতো ?
– ভদ্রলোক অনেকটা চেচিয়ে বললেন – আপনার কি মাথা খারাপ ! লুইকানের মতো আর্কিটেকট হাজার কোটি টাকা দিলেও ১ ইঞ্চি নকশা বদলাতো না !
আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম- ঠিক তাই । আমি বাংলাদেশ বিমান শ্রমিক লীগ বা সিবিএ’র প্রধান আর্কিটেক্ট । স্বাধীনতার পর বিমান কর্মীরা আমাদের প্রথম বারের মতো সিবিএ নির্বাচিত করেছে , তাদের বিশ্বাস ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কোন দেশী বা বিদেশী ব্যবসায়ীর হাতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবসা তুলে দিব না । ১৩ কোটি কেন ১৩শ কোটি টাকা দিলেও আমার সে ভাবনার ডিজাইনে কোন পরিবর্তন আসবে না।
ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন! অবাক হলাম অবশেষে আমাদের কমিটির তালিকা বেড় করে ভিলেনের মতো নাড়াচাড়া করে বললেন
– আপনাদের এ কমিটির মেয়াদ কতো দিনের ?
– মৃদু হেসে বললাম আপনার আশা কখনোই পূর্ণ হবে না ।
এখন দেখি হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরে পুরা কার্গো ভবন আগুনে জ্বলছে ! আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার ব্রিগেড অনুমতি না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ! আগুনের লেলিহান শিখা স্মরণ করিয়ে দেয় – পুরনো সেই ধূসর স্মৃতি !
এখন আর শেখের বেটি নেই , যাকে আপনারা ফেসিষ্ট বলেন , যিনি বিমান কে ভালবেসে কর্মীদের কথা চিন্তা করে গ্রাউন্ড হ্যন্ডলিং এর ফাইল ফেরত দিবে ! চট্টগ্রাম নৌ বন্দর নেই , এবার ঢাকা বিমান বন্দর যাবে ! একে একে কি সব যাবে !
জীবনানন্দ দাশের মতোই শঙ্কা জাগে
“মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষণ্ণতা।
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা॥