আহমাদ ইশতিয়াক।
ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের সামনে তখন হাজারো মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনার জমায়েত। উপস্থিত সবার মাঝেই পিনপিন নীরবতা। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে যুদ্ধ করা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সবার মুখের কথাই যেন হারিয়ে গেছে। প্রস্তাবটি যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া। সবাই জানেন এ যাওয়া যে নিশ্চিতভাবেই শেষ যাত্রা। কে পারবেন দেশের তরে এবার নিজেকে উৎসর্গ করতে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের প্রস্তাব ‘কে যাবে কামালপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে?’ উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা তখনো ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন। হঠাৎই রোগা পাতলা এক কিশোর সটান করে দাঁড়িয়ে বললেন ‘আমি যাবো।’ ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের মুখে তখন অবিশ্বাসের ছোঁয়া। এই ছোকরা যাবে! আসলেই কি ঠাট্টা নাকি সত্য। তিনি ফের জিজ্ঞেস করলে অনড় উত্তর সেই কিশোরের; ‘স্যার আমিই যেতে চাই। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের জায়গায় গেলেন না। সেই কিশোরের হাতে তুলে দিলেন একটি সাদা পতাকা আর একটি খাম। যে খামে রয়েছে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবের চিঠি। সেদিনের সেই ১৫ বছর বয়সী কিশোর বর্তমানে ৭০ বছরের বৃদ্ধ। তিনি বশির আহমেদ বীরপ্রতীক। একাত্তরে তিনি ছিলেন কামালপুর স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। এই কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে থাকেন জামালপুরের বকশীগঞ্জে। আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা শুনতে হানা দিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। বাকিটা শুনি তাঁর মুখেই। ‘ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বহুত আচ্ছা বহুত আচ্ছা। ঠিক হ্যায়!’ এরপর তিনি আমার হাতে একটি চিঠির খাম আর একটি সাদা পতাকা দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে তুমি কামালপুর বিওপিতে যাবে। চিঠিটা তুমি পাকিস্তানি অফিসারের হাতে দিবে। তবে প্রথমে কিন্তু তুমি ক্যাম্পে ঢুকবে না। ক্যাম্প থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ইশারায় সাদা পতাকা আর খামটি দেখিয়ে ওদের আসতে বলবে। যদি ওরা গুলি করা শুরু করে তুমি শুয়ে পড়বে। তখন আমরা এপাশ থেকে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করবো। তুমি ক্রল করে এখানে চলে আসবে।’ বশির আহমেদ যখন সেদিনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন তিনি যেন ফিরে যাচ্ছিলেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুরের যুদ্ধ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং বিপজ্জনক যুদ্ধ। ১৮০ দিনব্যাপী চলা এই যুদ্ধে কেবল সেট পিস যুদ্ধই হয়েছে চারবার। বর্তমানে কামালপুরের যুদ্ধ পড়ানো হয় বিশ্বখ্যাত বহু সামরিক কলেজসমূহে। মুক্তিযুদ্ধের নভেম্বরের শেষ দিকে কামালপুর বিওপিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর মরণকামড় বসান মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে কামালপুরে থাকা হানাদার সেনারা। বন্ধ হয়ে যায় হানাদারদের সমস্ত রসদ ও গোলাবারুদ সরবরাহ। বহু চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ ভাঙতে ব্যর্থ হয় হানাদার বাহিনী। টানা ১১ দিন অবরুদ্ধ রাখার মধ্য দিয়ে কামালপুরে থাকা হানাদারদের সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেয় মুক্তিবাহিনী। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে আক্রমণের পরপরই এদিন রাতে শুরু হয় পাক- ভারত যুদ্ধ। তখন মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে আসে ভারতীয় বাহিনীও। ফের ফিরে যাই বশির আহমেদের কথায়। তিনি বলতে থাকেন ‘আমাদের কোম্পানির অবস্থান ছিলো বানরোডের কাছে। সন্ধ্যার দিকে ভারতীয় মেজর জওহর সিং এসে বললেন, পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিবে একটু পর। তোমরা বিমান হামলা থেকে বাঁচতে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে নাও। তখন আমি আর এক ভারতীয় হাবিলদার ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সেখানে আশ্রয় নিলাম।’ রাতেই মহেন্দ্রগঞ্জে ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টারে বৈঠক হয় ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার ও ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক স্কোয়াড্ৰন লিডাৱ এম হামিদুল্লাহ খান সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হবে। যদি তারা প্রস্তাবে রাজি না হয় তবে বিমান হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে কামালপুর বিওপি। বশির আহমেদ বললেন, ‘রাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে খবর পাঠানো হলো পরদিন সকালে যেন ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হয়। পরদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমাদের ক্যাম্পে আসলেন। ততোক্ষণে বহু মুক্তিযোদ্ধা হাজির হয়ে গেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোন একজনকে কামালপুর বিওপিতে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে যেতে হবে। কে চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যেতে পারবে?’ আমরা জানি পাঞ্জাবিরা হলো রুক্ষ মেজাজের। ওদের সামনে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। সুতরাং সবাই নীরব থাকলো। তখন তিনি বিভিন্ন ক্যাম্পে ওয়্যারলেসে প্রস্তাব দিয়ে জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউই রাজি হলেন না। তখন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘দেখো তোমাদের দেশের জন্য আমরা জীবন দিয়ে দিচ্ছি। অথচ তোমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাও মরতে রাজি হচ্ছোনা।’ একপর্যায়ে আমার মনে হলো মৃত্যু তো জীবনে একবার আসবেই। দেশের জন্যই নয়তো মরবো। আমি তখন হাত উঠিয়ে বললাম ‘স্যার আমি যাবো।’ বশির আহমেদের চোখেমুখে ভিড় করে রাজ্যের উৎসাহ। আমরাও কান পাতলাম। তিনি বললেন, ‘ বর্ডার থেকে কামালপুর বিওপির দূরত্ব ২০০০ গজ হবে। তখন পুরোটা ফাঁকা থাকায় পরিস্কার দেখা যেত। আমি চিঠি আর পতাকা নিয়ে কামালপুর বিওপির পাকিস্তানি ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দিলাম। পাকিস্তানি সেনারা আমাকে দূর থেকে আসতে দেখে বাঙ্কারে ঢুকে গেল। আমি তখন হাত উঁচিয়ে পতাকা আর সাদা খামটা দেখালাম। প্রথমে ওরা কেউ আসছিলো না। কিছুক্ষন পর আমাকে ইশারায় ক্যাম্পের দিকে আসার জন্য ডাকলো। আমি মনে মনে আল্লাহ’র নাম স্মরণ করে হেঁটে বিওপির গেইটে চলে এলাম। একজন অফিসার আমার থেকে পতাকা আর খাম নিয়ে বসতে বলে ভিতরে ঢুকে গেল। একজন হাবিলদারকে বলে গেল আমাকে দেখতে।’ কিন্তু দেখলাম অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও ওরা ক্যাম্পের বাইরে আসছে না। এর কয়েক মিনিট পরেই কামালপুর বিওপির উপর ভারতীয় বিমান আক্রমন শুরু করলো। বোমার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাকে নিয়ে সেই হাবিলদার একটি বাঙ্কারের ভিতরে ঢুকে গেল।’ বশির আহমদ বিওপি থেকে ফিরে না আসায় যৌথ বাহিনী ভেবেছিলো তাঁকে হয়তো হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন আরো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হবে। কিন্তু এবার তো আরো অনিশ্চয়তা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে কে রাজি হবেন। রাজি হলেন আনিসুল হক আকন্দ সঞ্জু নামের এসএসসি পরীক্ষার্থী একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। বশিরের মতো তাঁকেও পাঠানো হয়েছিলো একইভাবে। তাঁর হাতে দেয়া হয়েছিলো ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের লেখা আরেকটি পত্র। পত্রে লেখা পাকিস্তানি বাহিনী যদি আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে এখনো রাজি না হয় তবে বিমান হামলা চালিয়ে নিমিষেই মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয় পুরো বিওপি। একপর্যায়ে আনিসুল হক সঞ্জুও যথানিয়মে উপস্থিত হন কামালপুর বিওপির সামনে। বশির আহমেদ বলেন, ‘সঞ্জুও ঠিক আমার মতোই এলো। দূর থেকে ওকে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন আহসান মালিক আমাকে বললো, ‘মুক্তি তোমারা দুসারা আদমি আয়ে গি।’ ওকে ডেকে নিয়ে ওর হাত থেকে চিঠির খামটি নিয়ে ভিতরে চলে গেল ক্যাপ্টেন মালিক। আমি সঞ্জুকে তখন বললাম, ‘আমি মরেছি তো মরেছি তুমি আসলে কেন?’ ও বললো ‘দেশের জন্য এসেছি।’ কিছুক্ষণ পর ভারতীয় বিমান এসে বোমা ফেলতে শুরু করলো কামালপুর বিওপির উপর। বোমার স্প্লিন্টারে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আহত হলো। তখন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক দৌড়ে এসে আমাদের হাতে সাদা পতাকা ও চিঠি দিয়ে বললো ‘তোমরা বিমানকে এটা দেখাও, আমরা আত্মসমর্পণ করবো। আমরা তখন বেরিয়ে এসে বিওপির সামনের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বিমানের উদ্দেশ্যে পতাকা আর চিঠিটা উঁচু করে ধরে নাড়তে লাগলাম। তখন ভারতীয় বিমান ফিরে গেল। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ার আগে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের সঙ্গে। সেই প্রস্তাব নিয়ে একটি চিঠি তুলে দেয়া হয় বশির আহমদের হাতে। তিনিই বললেন বাকিটা।ক্যাপ্টেন মালিক আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে উর্দুতে বললো ‘চিঠিটা ব্রিগেডিয়ার সাহেবের হাতে দিয়ে একটা চিঠি নিয়ে আসবে। আমি চিঠিটা নিয়ে রওয়ানা দিতেই দেখলাম বর্ডারের পাশেই সবাই উপস্থিত। ভারতীয় লেফটেন্যান্ট আবদুল মালেক ও গোর্খা রেজিমেন্টের এক ক্যাপ্টেন দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের কাছে নিয়ে গেলেন বুঝলাম তাঁরা ততোক্ষণে বুঝে গেছেন পাকিস্তানিরা যে আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে । আমি ব্রিগেডিয়ারের হাতে চিঠি দিতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর দুইপক্ষের মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলাপের পরে ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর শুরু হয় আত্মসমর্পণের পর্ব। ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ পাকিস্তানি সেনা ও ৩০ মিলিশিয়া ও রেঞ্জার সেনা আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। এর সাথেই মুক্ত হয় জামালপূরের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কামালপুর। দুই কিশোরের হাত ধরেই ৫৪ বছর আগে আজকের দিন তথা ৪ ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়লো কামালপুরের মাটিতে। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বশির আহমেদ বীর প্রতীকের চোখ ছলছল করে উঠে। তিনি বললেন ‘আমার তখনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না আমাদের কামালপুর স্বাধীন হয়ে গেছে। কামালপুর যুদ্ধেই আমি হারিয়েছিলাম আমার জ্যাঠা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম। কামালপুর মুক্ত দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সকল শহীদ ও অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি।