শুন্যতায় ভরা আলো

শুন্যতায় ভরা আলো

জুয়েনা ইয়াছমিন

 

ঢাকা শহরের এক টিউশন সেন্টারে প্রথম দেখা রিদোয়ান আর ধ্রুবীর। দু’জনেই মেধাবী, স্বপ্নবান, উচ্চশিক্ষার পথে ছুটে চলা। রিদোয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ধ্রুবী ইংরেজি সাহিত্য।

প্রথম পরিচয়ের দিনই ধ্রুবীর মনে হয়ছিল – এই ছেলেটি ওর বড্ড আপন কেউ। ওর ভিতরে অদৃশ্য কেউ বা অচেনা এক অনুভূতি যেন তাকে বলছিল- ‘এ-ই সে’।

ধ্রুবী মোটামুটি সুন্দরী একটা মিষ্টি মেয়ে ছিল, তবে তার সৌন্দর্য শুধু চেহারায় নয়—তার হাসি, তার কথা বলার ভঙ্গি, তার আত্মবিশ্বাসে ছিল। রিদোয়ানের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস, আর দায়িত্বশীল স্বভাব, চমৎকার ভরাট গলার স্বর ধ্রুবীকে মুগ্ধ করেছিল।

কিছুদিনের মধ্যে তাদের বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণতি পেয়েছিল।

পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও দু’জন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে দু’জনের পরিবারই পরে মেনে নিয়েছিল। ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর পাঁচ বছর ছিল যেন এক রঙিন উৎসব। দু’জন মোটে মানুষ হলেও বড় একটি ফ্ল্যাটে দু’জনে সংসার পাতলো, ধ্রুবীর বড় ফ্ল্যাট ছাড়া দম বন্ধ লাগত। রিদোয়ান ধ্রুবীর সবকিছুকেই ভলোবাসতো, ওর কোনো চাওয়ায় কোনো আপত্তি করত না। সে জানত, ধ্রুবী বড় ফ্ল্যাটের জীবন তাদের দু’জনের আয় থেকে ঠিকই চালিয়ে নিতে পারবে। ধ্রুবীর এই একটা চাওয়া ছাড়া সব চাওয়া-পাওয়া থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিল। ভালোবাসায়, স্বপ্নে, হাসি-কান্নায় ভরা তাদের সংসার পাঁচবছর পার করেছিল। রিদোয়ান তার পড়াশোনা শেষে নামী প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছিল। ধ্রুবী একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করল।

ওদের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই বলত,

—তোমরা দু’জন যেন একে অপরের আয়না। এমনটা খুব একটা দেখা যায় না।

কিন্তু জীবনের প্রতিটি বাঁকেইতো কিছু অচেনা সময়, অচেনা গল্প লুকিয়ে থাকে।

ওদের জীবনের বাঁকেও কাঁটা হয়ে এল রিদোয়ানের মা। বউয়ের প্রতি ছেলের অগাধ ভালোবাসা আর বিশ্বাস রিদোয়ানের মা’কে করে তুলল ঈর্ষান্বিত ও ইনসিকিউরড।

রিদোয়ান তার মাকে অনেক ভালোবাসতো। সেই মা-ই ধীরে ধীরে ধ্রুবীর বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে শুরু করলেন রিদোয়ানের কানে।

—তোর বউ তোকে ব্যবহার করছে।”

—এত স্বাধীনতা দিলে মেয়েরা মাথায় চড়ে বসে।

—আমার কথা তুই ভুলে যাচ্ছিস।

রিদোয়ান ভেতরে ভেতরে জানত, এসব সত্যি নয়। ধ্রুবী তাকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসে।

তবু মায়ের প্রতি দুর্বলতা তাকে দোটানায় ফেলত।

ধ্রুবী যেন রেদোয়ানের ভিতরের সমস্ত ফিলিংস বুঝতে পারত। সে মেনে নিতে পারছিল না তার ভালোবাসার পরিবর্তন। ধীরে ধীরে সে ভেঙে পড়তে শুরু করল।

রাতের পর রাত সে ঘুমাতে পারত না। কষ্টে কষ্টে সে নীল হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কাউকে বলতেও পারত না, কাঁদতেও পারত না। ধ্রুবী কখনোই খুব একটা কাঁদতে পারত না, আর আনন্দের কথা ছাড়া কষ্টের কথা শেয়ার করতে পারত না। স্পেশালি নিজের আপনজনদের নিয়ে কষ্টগুলোকে। তবুও সে দিনের বেলায় ক্লাসে হাসি মুখে দাঁড়াতো।

সে শুধু চাইত—রিদোয়ান একবার দৃঢ়ভাবে তাকে বলুক, সে সবসময় ওর পাশে থাকবে।

কিন্তু রিদোয়ান পারল না।

পাঁচ বছরের সেই সুন্দর সংসার ভেঙে গেল।

ধ্রুবী অনেকটা দিশেহারা হয়ে গেল যেন। কাউকে কিছু শেয়ার করতে পারে না, প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।

চুপচাপ শুধু তাকিয়ে থাকা, কষ্টে বুক ফেটে যেত। কিন্তু প্রকাশ করতে পারত না। কখনো সারারাত ঘুমাতো না, কখনো কান্নায় ভিতরে দম আটকে আসত, কাঁদতে পারত না। বুকের ভিতর কান্নারা শুধু নিঃশব্দে কাঁদতো।

এসময়টায় ওর পরিবার তাকে আগলে রেখেছিল। ধীরে ধীরে চিকিৎসা, যত্ন আর সময়ের জোরে একসময় সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরল।

ক্লাসে ফিরে দাঁড়াল, আবার পড়াতে শুরু করল। বাইরে থেকে মনে হত ধ্রুবী শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে এখনও রিদোয়ানকেই বাঁচিয়ে রেখেছিল।

প্রায় সাড়ে চারবছর পর একদিন হঠাৎ খবর পেল—রিদোয়ান আবার বিয়ে করেছে।

ধ্রুবী খবরটা শুনল শান্ত মুখে, অভিব্যক্তি ছিল আরও শান্ত। কারো সামনে কাঁদলোও না।

কিন্তু তার অবচেতন মনের ব্যথা শরীরকে আঘাত করল।

খবরটি শোনার কয়েকদিন পরেই সে হঠাৎ প্যারালাইজড হয়ে গেল।

পরিবার আবার পাশে দাঁড়াল। উন্নতমানের চিকিৎসায় আর পরিবারের যত্নে কয়েক মাসের মধ্যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল সে।

সুস্থ হওয়ার পর একরাতে ধ্রুবী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলল—

আমি আর ভেঙে পড়ব না। এই জীবনে আমি পরিবারের জন্য, নিজের জন্য বাঁচব। ওর জন্য নয়, অন্য আর কারো জন্য নয়। জীবনটা এবার শুধু আমার ও আমার পরিবারের।

সময়ের স্রোতে ধ্রুবী নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে নিজের একটা জগৎ গড়ে তুলল-

শিক্ষার্থীদের মাঝে, বইয়ের ভেতর, নিজের পরিবারের হাসি-কান্নার ভেতর।

একুশ বছর পূর্ণ হলো তার বিয়ের।

পাঁচ বছর সে ছিল রিদোয়ানের স্ত্রী, আর ষোল বছর সে একা।

প্রায়দিনই সহকর্মীরা সিরিয়াসলি তাকে বলে –

—আপনার বিয়ে করা উচিত ছিল, একা থাকা খুব কঠিন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার আসলেই ঠিক হয়নি।”

ধ্রুবী হেসে উত্তর দেয়,

—আমি একা থাকার সবগুলো চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একদিন যদি একাকীত্ব কষ্ট দেয়, তবে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব। বৃদ্ধরা মিলে মিশে ভালোইতো থাকে। কিন্তু ঐ ভদ্রলোকের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারব না।

___

সেদিন ছিল তাদের বিয়ের ২১তম বার্ষিকী।

ধ্রুবী পরিবারকে, এমনকি ওর কলিগদেরও বলল

—২৪ তারিখ আমি আমার বিবাহবার্ষিকী পালন করব। তবে একটু আলাদা করে।

পরিবার ও কলিগরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল—

—কীভাবে?

সে শান্ত গলায় বলল—

— পাঁচ বছর ছিলাম স্ত্রী, ষোল বছর একা। আজকের দিনটা আমার জীবনের সাক্ষী। ভালোবাসা, কষ্ট, একাকীত্ব—সবকিছু মিলিয়ে আমি একজন অন্যরকম মানুষ। আজ আমি সেই মানুষটাকেই উদযাপন করব, আমার আমিকে।”

সেদিন মনখারাপের সন্ধায় সে একা ছাদে চলে গেল এবং আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

চোখে জল চিকচিক করলেও কান্না এল না। ঠোঁটে দৃঢ় হাসি নিয়ে মনে মনে বলল—

রিদোয়ান, তুমি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে আজকের তুমি নও, সেই পাঁচবছরের তুমি, যে সময়টায় তুমি শুধু আমার ছিলে। আজতো তুমি অন্য কারো, আমার অন্যের জিনিসের প্রতি লোভ নেই। কখনোই ছিল না, আজও নেই। তবুও তুমিই আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার আজকের জীবনটা তোমার দেওয়া উপহার এবং অভিজ্ঞতা। আজ আমি শিখেছি, মানুষ ভেঙে পড়লেও আবার তাকে উঠে দাঁড়াতে হয়। আমি বাঁচব—আমার মতো করে।

ধ্রুবী আজও এমন অনেককিছু থেকে দূরে থাকে যা রিদোয়ানের সাথে কাটানো সময়গুলোতে করত। আবার এমন অনেককিছুই করে যেসব ঐ সময়টাতে করত না- নিজের ইচ্ছায় শাড়ি পরে, সাজে, কপালে টিপ দেয়, ছবি তোলে। সবার সাথে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটাতে চায়, কাটায়। তবে কোনো পুরুষ মানুষের সাথে নয়। সে প্রায়ই নিজেকে এবং অন্যদেরকেও বলে-

মরার পরে বেহেশতে গিয়েও সে আল্লাহকে বলবে, হে মহান আল্লাহ তুমি আমাকে কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গী করো না। আমাকে পৃথিবীর আমার পরিবারের সকলকে এবং বিশ্বস্ত সবগুলো মেয়ে বন্ধুকে সঙ্গী করে দিয়ো, আর একটা বিশাল সবুজ বন দিয়ো।

এভাবেই সে নিজের ভিতরের আলোকে নিভে যেতে দেয়নি।

সে কবিতা লেখে, গল্প লেখে, বই পড়ে, ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করে, পরিবারকে আগলে রাখে।

মানুষ তাকে বলে—“তুমিতো একা।”

কিন্তু ধ্রুবী জানে—সে একা নয়।

তার ভেতরে আছে এক অপূর্ণ আলোর দীপশিখা, যা তাকে সারাজীবন পথ দেখাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *