কিংবদন্তী আবুল ফতেহ।
আহমাদ ইশতিয়াক।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই মানুষটির অবিস্মরণীয় ঘটনাটি হলিউডে ঘটলে হয়তো এতোদিনে অস্কারজয়ী একটি সিনেমাও হয়ে যেত।
একাত্তরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় তখন। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ।
বাঙালিদের মধ্যে তখন তিনিই সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। রাষ্ট্রদূতের আলিশান জীবনে কোনকিছুর কমতি নেই। এক নিশ্চিন্তের জীবন। বিলাসিতা, প্রাচূর্য, ক্ষমতা; কি নেই সেই জীবনে?
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরানের রাজধানী তেহরানে পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাষ্ট্রদূতদের বৈঠকের আহ্বান করেন। এর পাশাপাশি তেহরানে তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় জোট সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশনের একটি বৈঠকও হবে। সেখানেও উপস্থিত থাকতে হবে রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহকে।
আবুল ফতেহ সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। অনেক কিছুই তৈরি করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং তেহরানেও পাঠালেন। ১৫ আগস্ট অফিসের গাড়িতে করেই বাগদাদ থেকে তেহরান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ফতেহ। বাগদাদ থেকে তেহরানের সড়ক পথে দূরত্ব ছিল প্রায় ৯০০ কিলোমিটার।
নির্দিষ্ট দিন রওয়ানা দেয়ার আগে আবুল ফতেহ ভাবলেন দূতাবাসের ব্যাংক একাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা তুলতে হবে। দূতাবাসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিলো রাফিদায়িন ব্যাংকের কারাদাৎ মরিয়ম শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রদূত হওয়ায় আবুল ফতেহ নিজের সই দিয়ে একাউন্টের লেনদেন করতে পারতেন।
আবুল ফতেহ ব্যাংকের ম্যানেজারকে জানালেন যে, দূতাবাসের তহবিল থেকে তাঁর টাকা তোলা দরকার। এবং ব্যাংক বন্ধ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে তিনি আসবেন।
কিন্তু ব্যাংক বন্ধ হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পরে আবুল ফতেহ ব্যাংকে গেলেন। তিনি জানতেন, ব্যাংক ম্যানেজার পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং এক ঘণ্টা দেরিতে সেখানে গেলে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত হবে।
বিষয়টি কিছুটা সন্দেহপ্রবণ হলেও ব্যাংক ম্যানেজার তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি ইরাকি কর্তৃপক্ষের নজরে আনেননি। পাকিস্তানী দূতাবাসের ব্যাংক একাউন্টে থাকা প্রায় ২৮ হাজার পাউন্ডের পুরোটাই উত্তোলন করলেন আবুল ফতেহ।
নির্দিষ্ট দিনে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসের গাড়ি নিয়ে তেহরানে যাওয়ার জন্য রওয়ানাও হলেন আবুল ফতেহ। সঙ্গে তাঁর গাড়ি চালক। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা যেতে চাইলেও তিনি না করলেন। ইরান সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছাতেই আবুল ফতেহ গাড়ি চালককে বললেন তাঁর বুকে ভীষণ ব্যথা করছে। ব্যথা কিছুতেই কমছে না।
গাড়ি চালক ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আবুল ফতেহ বললেন, এই শারীরিক অবস্থায় যাওয়া সম্ভব না। আমাদের বাগদাদে ফিরতে হবে। তাঁরা রাতে পুনরায় বাগদাদে ফিরে এলেন। বাগদাদের আল মনসুর শহরের কাছাকাছি আসতেই ফতেহ গাড়িচালককে বললেন, ‘এখন আমার অনেকটা ভালো লাগছে। আর আমি আগামীকাল বিমানেই তেহরান যাবো। যেহেতু আমি বিমানেই যাচ্ছি তাই তোমার আর আমার সঙ্গে যেতে হবেনা।
বাগদাদে ফিরে আবুল ফতেহ যা করলেন তা অবিশ্বাস্য। বাসায় ফিরে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের জানালেন আমার ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর তিনি বাসার দুই কাজের লোককে সিনেমা দেখতে ছুটি দিয়ে দিলেন। কাজের লোকরা যখন তাদের কোয়ার্টারে চলে গেল আবুল ফতেহ’র স্ত্রী পিছনের দরজা লাগিয়ে দিলেন। আবুল ফতেহ তাঁর ছেলেদের বললেন, আমরা আজ রাতেই ইরাক ছাড়বো। কারন আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে হবে।
এরপর আবুল ফতেহ ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় তাঁদের মালামাল একটি ভ্যানে ভারতীয় দূতাবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই রাতেই ফতেহ তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের একটি গাড়িতে করে কুয়েতের সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ১৬ আগস্ট ভোরে তাঁরা কুয়েত সীমান্তে পৌঁছান। গোয়েন্দা কর্মকর্তা গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে ফতেহ’র পরিবারের পাকিস্তানি কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে নেন।
এদিকে ফতেহ’র পরিবারের সবাই আতঙ্কিত এই ভেবে যে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের পাসপোর্ট ভারতীয় কূটনৈতিক পাসপোর্টের পাশে রাখলে সীমান্ত বাহিনীর কর্মকর্তারা কি ভাববে? একপর্যায়ে তাঁরা গাড়িতে বসে না থেকে ডেস্কে কি হয় তা ভেবে উঠে গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে নিরাপত্তা চৌকিতে ঢুকলেন।
সীমান্তে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা তাঁদের অভিনন্দন জানায় এবং পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়। ঐ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান তিনি একজন পাকিস্তানী। ফতেহ’র পরিবারের সদস্যরা কিছুটা আতংকিত হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই গোয়েন্দা জানালেন তিনি পাকিস্তানী হলেও ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন। এই যে আবুল ফতেহ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা যে সীমান্ত অতিক্রম করছেন তাঁর কোন প্রমাণই রাখা হলোনা।
সেদিন খুব ভোরে দুটি কূটনৈতিক গাড়ি ঐ সীমান্ত তল্লাশি চৌকিতে কেন তা জানার আগ্রহ থেকেও ভাগ্যক্রমে কোনো ইরাকি কর্মকর্তা কোনো পদক্ষেপ নেননি।
কুয়েত সিটিতে পৌঁছে আবুল ফতেহ ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের স্থানীয় কার্যালয়ে যান। ম্যানেজারকে আগেই বলা হয়েছিলো কয়েকজন বিশেষ যাত্রী এখান থেকে যাবে। কিন্তু তাদেরকে সাধারণ মানুষের নজরের বাইরে রাখতে হবে। এরপর সেখান থেকে তাঁরা লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য কুয়েত বিমানবন্দরে যান।
কুয়েত বিমান বন্দরে বিওএসির এক প্রতিনিধি যাত্রীদের নামের তালিকার সঙ্গে আবুল ফতেহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখতে শুরু করলেন। কিন্তু যাত্রীদের নামের তালিকায় তাঁদের নাম নেই। তখন একজন ভারতীয় দৌঁড়ে ডেস্কে গিয়ে ওই প্রতিনিধির দিকে হাত নাড়েন। তিনি কুয়েতে বিওএসি’র সহকারি ব্যবস্থাপক। যাত্রীদের তালিকায় তাঁদের নামের বদলে চারটি ভুয়া নাম দেওয়া হয়েছিলো।
কুয়েতে বহু ইরাকি এজেন্ট ছিলো এবং কুয়েত বিমান বন্দর থেকে যাত্রার বিষয়টি পুরোপুরি গোপন রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
লন্ডনে পৌঁছে আবুল ফতেহ এরপর ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের কাছে তারবার্তায় এই সংবাদ পাঠান।
২১ আগস্ট লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আবুল ফতেহ ঘোষণা দেন, ‘আমার মাতৃভূমি আর যুদ্ধবিধ্বস্ত। বাংলার প্রতিটি প্রান্তে আজ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে শ্মশানে পরিণত করেছে। আমার এই মুহূর্তে দায়িত্ব আমার সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমির পাশে দাঁড়ানো।’ একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে যে প্রহসন চলছে আমার দেশে যেভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে এরপর আমি আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারিনা। এখন আমার একমাত্র দায়িত্ব, আমার দেশের জনগণকে হানাদার মুক্ত করা।
বাগদাদ দূতাবাসের ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ ও নিজের জমানো মোটা অংকের অর্থ মুজিবনগর সরকারের তহবিলে পাঠিয়ে দেন আবুল ফতেহ।
আবুল ফতেহ’র স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন পাকিস্তানের গোটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তো বটেই পুরো পাকিস্তানকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন তাঁকে বলেছিল জেমস বন্ডের মতো ঠাণ্ডা মাথার অপারেশনাল কমান্ডার।
মুক্তিযুদ্ধে যেসব বাঙালি কূটনীতিক বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবুল ফতেহই ছিলেন সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
মুজিবনগর সরকার শুরুতে আবুল ফাতেহকে অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়। অগাস্টে তিনি প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন।
আবুল ফতেহ ছিলেন মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের কলেজ জীবনের সহপাঠী। ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে দুজনে একসঙ্গেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন। এরপর দুজনে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবুল ফতেহ ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগে আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইতিহাস বিভাগে। দুজন থাকতেনও একই হলে তথা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে।
একাত্তরের এপ্রিল মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বন্ধু আবুল ফতেহকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল এমন, প্রিয় বন্ধু এখন আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে লড়াই করে শত্রুমুক্ত করার সময়। নিশ্চয়ই তুমি এই সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার পাবেনা।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের পর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আটজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছিলো। উদ্দেশ্য বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
ওই দলে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের সচিব রুহুল কুদ্দুস সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। আর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আবুল ফাতেহ।
২২ ডিসেম্বর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত আবুল ফাতেহই ছিলেন দেশের মাটিতে সরকারের প্রধান প্রতিনিধি।
১৯৭২ সালে আবুল ফতেহ’র সঙ্গে প্যারিসে ইরাকের রাষ্ট্রদূতের দেখা হয়েছিলো। একাত্তরে এই ইরাকি রাষ্ট্রদূত ছিলেন ইরাকের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে কর্মরত।
আবুল ফতেহকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের কি ভয়ঙ্কর পরিণতি হতো সে বিষয়ে আপনার কোনো ধারণাই ছিলো না। পাকিস্তান সরকার জোরালোভাবেই সন্দেহ করতো, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়েছি। কিন্তু আপনারা কোথায় গেছেন সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য ছিলো না। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দি বিদ্রোহীরা আপনাদের অপহরণ করেছে।
তখন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেশের মধ্য থেকে আপনাদের খুঁজে বের করতে ইরাকের পুরো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। সেসময় বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া বিমানগুলোতে তল্লাশি চালানো হয়েছিলো এবং যেসব বিমান অল্প সময় আগে ছেড়ে গিয়েছিলো সেগুলোও ফিরিয়ে এনে সেগুলোতেও তল্লাশি চালানো হয়েছিলো।
২০১০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ৮৬ বছর বয়সে চিরতরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আবুল ফতেহ। শ্রদ্ধা জানাই আমাদের কিংবদন্তী আবুল ফতেহ’র প্রতি।