কাঁদতে কাঁদতে লিখছি এই অভিজ্ঞতা
কাজী জহিরুল ইসলাম
আমি হোটেলে এসেছি ভোর ৬টায়। হোটেলের চেক ইন টাইম বিকেল ৩টায়। মেয়েটি আমাকে বললো, স্যার, যত তাড়াতাড়ি রুম খালি হয় আপনাকে দিয়ে দেব।
আমি রিসেপশনে বসে আছি, একটু পরে এক যুবক এসে বলে, স্যার, আপনাকে কফি এনে দেই?
আমি একটা হাসি দিয়ে বলি,
অনেক ধন্যবাদ, আমি কফি হজম করতে পারি না।
যুবকের নাম বার্ক এগেম্যান। সে আরো খানিকটা কাছে আসে।
প্রথম এসেছেন ইস্তাম্বুলে?
ইস্তাম্বুলে অনেকবার এসেছি। তবে শুধু একবার, ২০০৪ সালে, এয়ারপোর্টের বাইরে একটু বেরিয়েছিলাম। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, আর কখনো বের হইনি। এয়ারপোর্ট থেকেই অন্য কোনো দেশে চলে গেছি।
এটা ঠিক হয়নি, আপনার মত মানুষের অনেক আগেই ইস্তাম্বুলে আসা উচিত ছিল।
আমি আসলে বার্কের কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি। হয়ত ওর ইংরেজি বলার অসামঞ্জস্য। ‘আমার মত মানুষের’ কথাটার অর্থ কী?
টার্কিশ এয়ারলাইন্স আমাকে দুই দিনের হোটেল দিয়েছে, সঙ্গে দুই দিনের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। যেহেতু আজ ৩টায় চেক ইন, তাই আজকের ব্রেকফাস্ট বরাদ্দে নেই, কাল, পরশু ব্রেকফাস্ট পাবো। আমি অবশ্য ক্ষুধার্তও না, বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের ওরা প্লেনে এতো খাবার দেয়, মনে হয় আগামী চব্বিশ ঘন্টা আর কিছু না খেলেও হবে।
বার্ক বলে,
আপনি সম্ভবত কিছু লিখছিলেন, আমি আর বিরক্ত না করি।
আমি বলি,
বার্ক, তুমি এতো ভালো ইংরেজি জানো কী করে?
স্কুলে শিখেছি। আর আমার অদম্য আগ্রহ, নতুন ভাষা, নতুন দেশ, নতুন মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই। আগ্রহ থেকেই শিখেছি।
স্যার, একটা কথা।
বলো না, আমি কিছু একটা লিখছিলাম কিন্তু এখন আর লিখবো না। আমিও তোমার মতই। নতুন দেশ, নতুন মানুষ সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য আজকের ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি।
মনে মনে খুব খুশি হই। ক্ষিধে নেই যদিও কিন্তু এই সম্মানটুকু গ্রহণের ক্ষুধা তো আছেই। ভাবছি বাঙালিরা পৃথিবীর নানান জায়গায় গেলে লেখক হিসেবে সম্মান করে, ভালোবাসা প্রদর্শন করে কিন্তু এই তুর্কি যুবক কেন করছে?
বার্ক নিজে আমাকে চারতলায়, বুফে রেস্টুরেন্টে, নিয়ে যায়। মাই গড। এতো দেখি এলাহী কাণ্ড। শত শত রকমের খাবার। শুধু জলপাই আছে ৮ রকমের। কত শত রকমের চিজ। রুটি যে কত রকমের গুনে শেষ করা যাবে না। বুফে ম্যানেজার কম বয়সী একটি মেয়ে। জানি না বার্ক ওকে কী বলে গেছে, এক নাক চ্যাপ্টা চীনে তরুণী আমার পেছনে লেগেই আছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে আর সব খাবারের বর্ণনা দিচ্ছে।
দ্রুত জানালার পাশে একটি টেবিল আমার জন্য তৈরি করে ফেললো। আমি খেতে বসেছি। শুধু কিছু সালাদ, নানান রকমের টার্কিশ ভর্তা: বেগুনের, অ্যাভোকাডোর, টমেটোর, শিমের আরো কত কী শব্জির, এইসবই নিলাম। চীনে মেয়েটি আশ-পাশেই আছে। একটু পর পর এসে জিজ্ঞেস করে আর কিছু লাগবে কী-না।
টার্কিশ চা, কফি দুটোই আমার প্রিয়। টার্কিশ কফির সঙ্গে ২৫ বছর আগের অনেক স্মৃতি জড়িত, টার্কিশ কফির কথা শুনলেই নস্টালজিক হয়ে পড়ি। কিন্তু এখন কফি একদমই সহ্য করতে পারি না। ঘুম নষ্ট হয়। পেটে যন্ত্রণা হয়। মেয়েটি কাছে এলে বলি,
টার্কিশ চা দাও।
ও সুদৃশ্য কাপে চা নিয়ে আসে।
খেয়ে দেয়ে নিচে আসি। দূর থেকে দেখি রিসেপশনে ৫ জন, ওরা সবাই দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের সার্ভিস দিচ্ছে। সকলেই বয়সে তরুণ-তরুণী। কিন্তু বার্ককে কোথাও দেখছি না। ভাবছি, বার্কের সঙ্গে একটু খাতির হয়েছিল, ও থাকলে হয়ত তাড়াতাড়ি রুম পেয়ে যেতাম। এখন এদেরকে আবার সব গোড়া থেকে বলতে হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রিসেপশন থেকে অন্তত ১৫ গজ দূরে থাকতেই একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে ছুটে আসে।
দুজন যুগল কণ্ঠে যেন গেয়ে উঠল,
স্যার, কোনো সাহায্য করতে পারি?
আমি কীভাবে শুরু করবো সেটাই ভাবছিলাম। বলি,
আমি আসলে রুমের জন্য অপেক্ষা করছি।
মেয়েটি বলে,
সেটা তো আমরা জানিই। একটা রুম খালি হলেই আপনাকে দেব। খালি হওয়ার পরে ক্লিন করতে হবে, তারপরই আপনি পাবেন। এখানে এখন ফুটবল খেলা চলছে, তাই কাল রাতে সব রুম সেল হয়ে গেছে।
ঠিক আছে।
তিনতলায় স্পা আছে। আপনি স্পা করতে পারেন।
আমি আসলে খুব ক্লান্ত, আগে জামা-কাপড় বদলাবো, ফ্রেশ হবো, তারপর অন্য কিছু।
আপনি চাইলে ফিটনেস সেন্টারের সেবা নিতে পারেন, আমাদের সউনাও আছে।
না থাক, এখানেই বসে থাকি। রুম খালি হলে জানাবেন।
আমি রিসেপশনে বসে পড়ি। সেলফোন বের করে লেখালেখির চেষ্টা করি।
হঠাৎ মনে হলো, যাই না কেন, দেখে আসি সউনা, জিম, স্পা। একটু সময় কাটুক। ওরা কিন্তু আমাকে চোখে চোখে রাখছে। সোফা থেকে উঠতেই অন্য এক যুবক ছুটে আসে।
আমি বলি,
আপনাদের জিমটা কোথায়, একটু দেখে আসি।
ও বলে, চলেন, আমি নিয়ে যাই।
রিসেপশন ফেলে?
কিচ্ছু হবে না, ওরা আছে।
আমি বলি,
না, না, কোথায় জিম সেটা বলুন। আমি একাই যেতে পারবো।
ও বলে,
তিনতলায়, জিম, সেলুন, সউনা, স্পা সব এক জায়গায়।
আমি তিন তলায় যাই। ওখানে যেতেই এক যুবক এবং এক তরুণী এগিয়ে এলো। মি. ইসলাম, এই নিন আপনার স্পা সেট। একগাদা টাওয়েল, কাপড়ের স্যান্ডেল, শাওয়ার স্যুট তুলে দিয়ে লকার, সউনা, শাওয়ার সব ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিল।
কী আর করা সময় কাটাই একটু। ৩০ মিনিট পর বেরিয়ে এলে অন্য এক মেয়ে এগিয়ে এসে বলে, আপনার রুম নাম্বার ১১০১, লাগেজ রুমে পাঠানো হয়েছে।
চাবি নিয়ে রুমে এসে অবাক। আমার ভাউচারে লেখা আছে সিঙ্গেল রুম কিন্তু এটা তো কিং সাইজ রুম, তাও আবার দুই দিকে উইন্ডো, চমৎকার ইস্তাম্বুল ভিউ। বিশাল কিং সাইজ বিছানা।
কিন্তু তখনও আসল সারপ্রাইজটি বাকি। দুটি চাবির কার্ডে চোখ পড়তেই চেনা চেনা লাগছে। দেখি কার্ড দুটিতে আমার নাম লেখা, শুধু তাই না আমার দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ মুদ্রিত। একটিতে 100 English Haiku অন্যটিতে Edelweiss. এটা কী করে সম্ভব!
এবার আমি আর আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না। ওরা নিশ্চয়ই আমার নাম দিয়ে গুগল সার্চ করে এসব বের করেছে এবং আমাকে সারপ্রাইজ দিতেই এই কাজ করেছে।
কাঁধের ব্যাকপ্যাকটা ফ্লোরের ওপর ফেলে আমি ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করি। এর চেয়ে বড়ো পুরস্কার আর কী হতে পারে? এতোক্ষণে সবকিছু আমার কাছে পরিস্কার হলো, কেন এতো আদর-ভালোবাসা। পৃথিবীর বহু দেশে বেড়াতে গিয়ে বহু অচেনা বাঙালির ভালোবাসা পেয়েছি।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে রোমে বেড়াতে গেছি, ওখানকার অচেনা বাঙালি শ্রমজীবী যুবকেরা আমাকে হোটেলে যেতে দেয়নি, বাসায় নিয়ে গেছে, গোল হয়ে বসে আমার গল্প শুনেছে। কিন্তু আজ ভিন দেশি একদল মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দিল, তাও খুব গোপনে, কোনো ক্রেডিট না নিয়ে, এর মূল্য অন্যরকম। এই স্মৃতি কোনো দিন ভুলবো না। সন্দেহ নেই, ইস্তাম্বুল আমাকে জয় করে ফেলেছে।
১ অক্টোবর। ইস্তাম্বুল, তুরস্ক।