একজন জীবনানন্দ
সুষুপ্ত পাঠক
এক মাথা চুল দাড়ি গোফ না রেখে, নেশাভাং না করে, চরম বহেমিয়ান, আড্ডাবাজী না করে, সাহিত্য সম্মেলন, একাডেমিতে ধরাধরি না করে, নিপাট ভদ্রলোকের মত ছোট ছোট চুল রেখে কখনো মাস্টারি, কখনো বেকার, এমন একজন মানুষ তাঁর সমকালীন তরুণ কবিদের তো বটেই, দশকের পর দশক এবং আজতক কবিদের উন্মত্ত করে রেখেছেন- তিনি জীবনানন্দ দাশ!
বাংলা সাহিত্যের এতবড় কবি তার বলতে গেলে কোন ছবি নেই! একটি মাত্র ছবি তাও পোকায় কাটা, ফ্যাঙাস পরে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কবির মৃত্যুর পর তার ভাই এডিটিং করে কোন মতে কবির একটা চিহ্ন রেখেছিলেন। সেই ছবিতে কবিকে আমরা পাঞ্জাবি পরা দেখলেও তিনি পাঞ্জাবি পরতেন না। দেহ ও মাথার সঙ্গে যে গলদেশ তা জীবনানন্দের ছিল না। পাঞ্জাবি পরলে ভালো দেখাতো না কবি বুঝতেন। তিনি শার্ট পরতেন, ধুতি আর চটি। মাল্যবানকেও এভাবেই সাজিয়ে ছিলেন কবি উপন্যাসে।
মাল্যবান হচ্ছে জীবনানন্দের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। সেখানে আমরা স্ত্রী লাবণ্যকে দেখতে পাই। ভদ্রমহিলা কবির প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হলে হয়ত কবি জীবনে একটু স্বস্তি মিলতো। এমন বিষাদ, অর্থচিন্তা, স্ত্রীর মুখঝামটা- এসব নিয়ে তিনি খাতার পর খাতা উপন্যাস গল্প লিখে গেছেন কিভাবে? ঘরে টাকা নেই, পায়ে ছেঁড়া চটি, এই ছাইপাশ উপন্যাস কবিতা গল্প লিখে কি হবে? এমন তো কেউ অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল না। মুদি দোকান দেবার কথাও ভাবছিলেন! মেয়ের জন্য ফ্রকের কাপড় কিনতে না পারা ব্যর্থ বাবা! কোন পত্রিকা তার পক্ষে নয়। এক বুদ্ধদেব বসু ছাড়া কেউ তার প্রতিভা বুঝতে পারেনি।
জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী লাবণ্যের কথাটা মনে পড়ে। কবি মারা গেলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায়। মৃত্যু সংবাদ শুনে এলেন রাজনীতিবিদ বড় বড় লেখক কবিরা। লাবণ্য বলবেন, এত বড় বড় মানুষরা এসেছে যখন তোমাদের দাদা নিশ্চিয় বড় কবি ছিলেন। কিন্তু আমার জন্য কি রেখে গেলেন?
শেষ বিদায়েও এতটুকু সম্মান পেলেন না? কি রেখে গেলেন? কবি কি রেখে যান? লেখক কি রেখে যান? শুধু লেখা। কবি লেখকদের বিয়ে প্রেম করতে নেই বুঝি!
দিনের পর দিন জীবনানন্দ ঘর থেকে তিরস্কার অপমান পেয়ে পেয়ে ‘মাল্যবান’ লিখলেন। সেই উপন্যাস বুঝার ক্ষমতা বাঙালি পাঠকের কোথায়?
একটা ট্রাম বহুকাল থেকে তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছিল। নাকি তিনি ট্রামকে? ঘুমে স্বপ্নে ট্রামের মৃদু যান্ত্রিক শব্দ কি তিনি পেতেন? দস্তভয়ভস্কি তো পেতেন। মৃগিরোগ উঠলেই তিনি এমন কিছু তো শুনতে পেতেন। প্রায় একই রকম গরীব, অর্থচিন্তায় অতিষ্ঠ, একই রকম তবু দস্তয়ভস্কি শেষ জীবনটা জীবনানন্দের মত নয়। হয়ত তাদের মধ্যে কোন মিল নেই। আসলেই নেই। আন্না আর লাবণ্য ছিল দুই বিপরীত জগতের মানুষ। আশ্চর্য হয়ে আমি জীবনানন্দের সঙ্গে অন্য সব মহানদের জীবনী মিলিয়ে ফেলি। তুলনা করি তাদের মত করে না হলেও জীবনানন্দ কি একটু সহানুভূতি পেতে পারতেন না ঘরে বাইরে? যখন বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ি, চাকরি বাকরি কিছুই করলেন না কেবল রাজনীতি করবেন বলে। ছেলেমেয়ে স্ত্রী কারোর ভারণপোষণ তো নিতে পারেননি উল্টো স্ত্রী সংসার সামলিয়ে টাকা জমিয়ে রাখতেন তাকে দেয়ার জন্য। কোনদিন বলেননি এবার একটা চাকরি করো, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত ভাবো। যখন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার কথা উঠলো পরিবার থেকে মুজিব অস্বীকার করলেন টাকা রোজগার করতে। তিনি পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগের বেঈমানী থেকে রাজনৈতিক পথ বেছে নিবেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন। সেদিন ফজিতুল নেসা লাবণ্যের মত হয়ে উঠলে মুজিব কোনদিন ‘বঙ্গবন্ধু’ হতে পারতেন না।
তার মানে কি জীবনানন্দ সংসার জীবনে সুখী হলে আরো আরো বড় কবি হতেন? না, বিষাদই বরং তাকে দিয়ে আমাদের জন্য মনি মুক্ত সম কবিতাগুলো লিখিয়ে নিয়েছে। কিন্তু একটু স্বস্তি, শান্তি কবিকে দিয়ে আরো প্রবন্ধ, আরো রাজনৈতিক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, আরো উপন্যাস, আরো গল্প লেখাতে পারতো। কিন্তু একটা ট্রাম তার পিছু নিয়েছিল। অথবা তিনি নিজেই নিয়েছিলেন ট্রামের পিছু…। তিনি ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। সোনালী জড়ির কাজ ফেলে শীতের রাতে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। লাশকাটা ঘরে সেই শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিল অবশেষে।